আজকের দিনে অর্থাৎ 1934 সালের 3রা অক্টোবর ভাওয়াইয়া সম্রাজ্ঞী প্রতিমা বড়ুয়া (Pratima Barua) জন্ম গ্রহণ করেন গৌরিপুরের (ধুবরি জেলা, আসাম) জমিদার পরিবারে। যেহেতু জন্ম কলকাতার বালিগন্জ সারকুলার রোডের বাড়িতে হয়েছিল তাই শৈশবের অনেকটা সময় তাঁর কলকাতায় কেটেছিল। উনি প্রথমে কলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে পড়াশোনা করেন পরে গৌরিপুরের বাড়িতে এসে গৌরিপুর গার্লস হাইস্কুলের (Gauripur Girls High School) ভর্তি হন।
রাজা প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া ছিল তার ঠাকুর্দা। রাজা প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়ার চারজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার কোনো সন্তান না থাকায় তিনি এক পুত্র সন্তান দত্তক নেন এবং তাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য উদ্যোগ নেন যাতে পরবর্তীতে জমিদারি সামলাতে পারে। জমিদারি ছাড়াও রাজা প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া (Raja Prabhat Chandra Barua) 1903 সালে আসাম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ অবদান ছিল তার। তিনি দুবার আসাম বিধানসভার সদস্যও নির্বাচিত হন।

রাজা প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়ার জৈষ্ঠ পুত্র হলেন প্রমোতেষ চন্দ্র বড়ুয়া (Pramatesh Chandra Barua) যিনি প্রথম কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Sharat Chandra Chattopadhaya) এর “দেবদাস” উপন্যাস (Debdas novel) অবলম্বনে সাদাকালো চলচিত্র নির্মান করেন এবং নিজেই দেবদাসের ভুমিকায় অভিনয় করেন। প্রমোতেষ চন্দ্র বড়ুয়ার দুই কন্যার নাম হল যথাক্রমে রাজকুমারী নিলিমা সুন্দরি বড়ুয়া (Princess Nilima Sundari Barua) আর রাজকুমারী নিহারবালা বড়ুয়া (Rajkumari Niharbala Barua)।
প্রকৃতিষ চন্দ্র বড়ুয়া (Prakritish Chandra Barua) ছিলেন রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়ার দ্বিতীয় পুত্র যিনি “লালজি” (Laljee) নামেও পরিচিত। লালজি ছিলেন ভারতের অন্যতম হাতি বিষারদ, হাতিকে বশ মানাতে পারদর্শী ছিলেন তিনি।
রাজা প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়ার কনিষ্ঠ পুত্র হল প্রনবেশ চন্দ্র বড়ুয়া (Pranabesh Chandra Barua) আর ভাওয়াইয়া সম্রাজ্ঞী প্রতিমা বরুয়া হল লালজি অর্থাৎ প্রকৃতিষ চন্দ্র বড়ুয়ার জৈষ্ঠ কন্যা। 1969 সালে প্রতিমা বরুয়ার বিয়ে হয় প্রফেসর গঙ্গাশঙ্কর পান্ডের (Professor Gangashankar Pandey) সহিত যার আদি বাড়ি ছিল উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলিতে।
প্রতিমা বড়ুয়ার গোয়ালপড়িয়া গান (Goalparia song) তথা ভাওয়াইয়া গানের সম্রাজ্ঞী হওয়ার পিছনে রাজকুমারী নিহারবালা বড়ুয়ার যথেষ্ট অবদান ছিল। তারই প্রচেষ্টায় একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় নির্মান করা হয়েছিল রাজবাড়ির ভিতরেই যাতে ফোক গানগুলো হারিয়ে না যায়। করিতুল্লা আর বয়ান শেখ ছিল সেই বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক আর আমিনা যে এক মাহুতের কন্যা ছিল, সে ছিল ভাওয়াইয়া গানের প্রথম ছাত্রী। আর একজন ছাত্রী ছিল সেই সময় যে ফোক গানের প্রতি মহা অনুরাগী ছিল সে আর কেউ নয়, তিনি হলেন প্রতিমা বড়ুয়া।

প্রতিমা বড়ুয়া বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন এবং অনায়াসে গ্ল্যামার জগতে প্রবেশ করতে পারতেন সঙ্গীতের মাধ্যমে। অন্যান্য সঙ্গীত শিল্পীদের মত তিনিও মুম্বই এ গিয়ে নিজের নাম কামাতে পারতেন কিন্তু ভাওয়াইয়াই যেন তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল। তিনি যথেষ্ট স্মার্ট ছিলেন, মাতৃভাষা কামতাপুরী /রাজবংশী ভাষা (Kamtapuri / Rajbanshi language) তো জানতেনই তাছাড়া অন্যান্য ভাষা যেমন অসমীয়া, বাংলা, হিন্দী আর ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তিনি “হস্তীর কন্যা” নামে বিখ্যাত ছিলেন। প্রতিমা বড়ুয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অফার পেয়েছিলেন কিন্তু ভাওয়াইয়া গানের বিশেষত্বকে কখনো কম্প্রোমাইজ করেন নি। তিনি তার জীবনকে ভাওয়াইয়া গানের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং ভাওয়াইয়াকে বিশ্বের দরবারে পৌছে দিয়েছিলেন।
ফোক গান তথা প্রতিমা বড়ুয়ার গানের বিশেষ 7টা বিভাগ হল-
1। বিরহ 2। দেহতত্ব 3। প্রেম 4। মৈশাল 5। মাহুত 6। কালা (কানাই) 7। মুসলমানী
প্রতিমা বড়ুয়ার গানগুলি শুনলেই পরিস্কার বোঝা যায় কোন গানটি কোন বিভাগে।
মৈশালের একটি গান যেমন-
ধিকো ধিকো ধিকো মৈশাল
ধিকো গাবুরালি
এহেনো সুন্দরো নাড়ি কেমোনে যাইবেন ছাড়ি মৈশাল রে
তখোনে না কৈছোং মৈশাল, নাযান গোয়ালপাড়া
গোয়ালপাড়ার চেংরিগুলা জানে ধুলা পোড়া
মৈশাল রে……..
হিন্দু দের মত মুসলমানদের বিয়ে বাড়িতেও বাজনার চল ছিল। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিন বাদ দিয়েও অনেক মুসলিম গান লেখক এবং গায়ক ছিল বা আছে যারা এই ভাওয়াইয়াকে সমৃদ্ধশালী করে রেখেছে।

ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের প্রথম প্রাণপুরুষ ছিলেন শ্রী সুরেন্দ্রনাথ রায় বসুনিয়া। 1937 সালে তিনি সর্বপ্রথম দুটি ভাওয়াইয়া গান HMV স্টুডিওতে রেকর্ড করেছিলেন। এনার আগে কেউ কখনো ভাওয়াইয়া গান রেকর্ড করেন নি, সুতরাং 1937 সালের সেই দিনটা ছিল ভাওয়াইয়ার এক উজ্জলতম দিন। পরবর্তীতে আব্বাসউদ্দিন যিনি ভাওয়াইয়া গান করে বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং ভাওয়াইয়াকে জাতীয় ও বিশ্বদরবারে পৌছে দিয়েছিলেন। আব্বাসউদ্দিন এর পরবর্তীতে যদি বলা যায় তাহলে প্রতিমা বড়ুয়াই যিনি এই ভাওয়াইয়াকে ভালোবেসে ভাওয়াইয়া কে জীবন্ত, প্রাণবন্ত করেছিলেন।
প্রতিমা বড়ুয়ার বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড-
1। পদ্মশ্রী অ্যাওয়ার্ড (Padmshree Award)
2। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (Sangeet Natok Academy Award)
3। Honour award by Rabindra Bharati University
4। D.Lit award by North Bengal University, Darjeeling
5। বিশেষ সম্বর্ধনা – আব্বাসউদ্দিন মেমোরিয়াল সমিতি
6। Honour to Pratima Barua by Indian Museum, Kolkata
7। কলাগুরু বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড
8। AASU’s Felicitation আরো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড রয়েছে যা গৌরিপুরের বাড়িতে (Exhibition hall) সজ্জিত আছে।
2002 সালের 27শে ডিসেম্বর প্রতিমা পান্ডে বড়ুয়া পরলোক গমন করেন। ভাওয়াইয়া সঙ্গীতে প্রতিমা বড়ুয়ার অবদানকে অসম সরকার সন্মান দিলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে এযাবৎ কোনো সন্মানই দেয়নি বলা চলে। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা ভাওয়াইয়ার সুরে সমৃদ্ধ অথচ প্রতিমা বড়ুয়ার সন্মানার্থে কোনো মূর্তি বা কোনো স্মারক সমিতি পর্যন্ত নেই।