কেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ কে আধুনিক কুচবিহারের রুপকার বলা হয়? 

প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে কুচবিহার কে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল যা এখানকার অধিবাসীদের জীবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। এখানকার রক্ষনশীল সমাজ এবং ঐতিহ্যের মধ্যেও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল।  

মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ কুচবিহার রাজ্যে বিভিন্ন দিকে পরিবর্তন এনেছিলেন এবং বলা চলে আধুনিক কুচবিহারের রুপকার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই ছিলেন। জন্ম 1862 সালের 4 অক্টোবর। 1863 সালের 6 আগষ্ট মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ মারা যাওয়ার পর মাইনর রাজা হিসেবে 10 মাস বয়সে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন তার মহারানী কামেশ্বরী দেবী, বৃন্দেশ্বরী দেবী ও নিস্তারিনি দেবী। কিন্ত ব্রিটিশ সরকার ছোটো মহারাজার সিংহাসন অধিষ্ঠান কনফার্ম করে 1864 সালের জানুয়ারি মাসে। নাবালক নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময়কালে মহারানী ত্রয়ের একটা ভয়ও কাজ করছিল যে হয়ত ব্রিটিশ সরকার পুরো রাজ্যকে অধিকার করে নিজেদের শাসনেই রাখবে। জে. সি. হটন সাহেব ছিলেন ঐ সময় গভর্নর জেনারেল এজেন্ট- নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার তথা কমিশনার অফ কুচবিহার ও নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার। 

যাইহোক ব্রিটিশ সরকার কমিশনারের আধিপত্য হাটিয়ে শেষ পর্যন্ত মহারাজার হাতেই কুচবিহারের শাসন ক্ষমতা রেখে দেন।  কলোনেল হটন সাহেব 1864 সালে কমিশনারের দায়িত্বে এসেছিলেন এবং 1873 পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন। প্রশাসনিক দায়িত্ব ছাড়াও তার তার বিশেষ দায়িত্ব ছিল যেটা সেটা হল যুব মহারাজা ঠিক ঠাক ভাবে বড় হচ্ছে কিনা অর্থাৎ তার কেয়ার নেওয়া।

1883 সালের 8 নভেম্বর মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণকে ফরমালি কুচবিহার রাজ্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 
মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলেই কুচবিহারের বিকাশের পূর্ণ রুপ পায়। তার আমলে বর্তমান রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। অন্যান্য কাজগুলির মধ্যে ছিল স্কুল নির্মান অর্থাৎ কুচবিহার বাসীকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। 
 
1873 থেকে 1874 এই সময়ে স্কুলের কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া হল-
স্টেট ইন্সটিটিউশন
হায়ার স্কুল – 1
মিডল স্কুল – 2
নরমাল স্কুল – 1
আর্টিশান স্কুল – 0
সাহায্যপ্রাপ্ত
ইংরাজী মিডল স্কুল – 2
মিডল ভার্নাকুলার – 52
লোয়ার ভার্নাকুলার – 33
নাইট স্কুল – 10
গার্লস স্কুল – 14
 সাহায্যপ্রাপ্ত নয়
মিডল স্কুল – 5
লোয়ার স্কুল – 10
গার্লস স্কুল – 6
নাইট স্কুল – 7
পাঠশালা – 42
মকতব – 12
সবমিলে 199 টি স্কুল
ঠিক এই সংখ্যাটাই 1874 – 75 এ হয়েছিল 245।
Coochbehar Palace
1873 – 74 এ যেখানে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা ছিল 4605 জন সেই সংখ্যাটা 1874 – 75 এ বেড়ে দাড়িয়েছিল 6497।
স্টেট সাহায্যপ্রাপ্ত নয় এমন স্কুলগুলি সাধারনত জোতদারদের সাহায্যে চলত। 
1879 – 80 সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট স্কুল সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছিল 390 এবং মোট ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা ছিল 11630।
 
মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বকালে লাইব্রেরী নির্মান হয়েছিল। রোড কানেক্টিভিটির যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছিল। 
বিভিন্ন ইন্সটিটিউশনের মধ্যে অন্যতম ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজ, সুনিতী অ্যাকাডেমি। তার আমলে প্রত্যেক মহকুমা শহরে স্কুল নির্মান হয়েছিল। মদনমোহন মন্দির নবরুপে নির্মান তিনিই করেছিলেন। 
শুধু শিক্ষা বিভাগ নয় প্রত্যেকটি বিভাগএর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যেমন
1। অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ও ক্রিমিনাল জাস্টিস 
2। জেইল ও লক আপ
3। পাবলিক ওয়ার্কস
4। এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট
5। মেডিক্যাল
6। মিলিটারি
7। পিলখানা
8। স্টেট প্রেস 
9। স্টেট লাইব্রেরী 
10। পুলিস
গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মধ্যে রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টও ছিল। রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন ভাগগুলির মধ্যে ছিল – 
1। ল্যান্ড রেভিনিউ 
2। সেটলমেন্ট
3। ট্রেজারি আর স্ট্যাম্প রেভিনিউ 
4। এক্সাইজ রেভিনিউ 
5। রাজবাড়ি অফিস
আর এক অন্যতম বিভাগ হল জুডিসিয়াল ডিপার্টমেন্ট। 
 
সুতরাং বলাই যেতে পারে যে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলে কুচবিহারে একপ্রকার নবজাগরণ শুরু হয়েছিল। কুচবিহারের এবং মহকুমা শহরের প্রায় সমস্ত পুরোনো লাল রঙের বিল্ডিং গুলি তারই আমলে তৈরী। অনেক পুরোনো বিল্ডিং এর ভগ্নাবশেষ এখোনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সরকারী ঔদাসিন্যে। কুচবিহার কে কেন্দ্রীয় সরকার হেরিটেজ শহর ঘোষনা করা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের ঔদাসিন্য সর্বত্র পরিলক্ষিত। পশ্চিমবঙ্গের সহিত কুচবিহার রাজ্য মার্জার একটা বড়সড় প্রশ্নচিন্হ যা সমগ্র কুচবিহার বাসীর পক্ষে শুভ না অশুভ তা বর্তমান কালে বিভিন্ন আন্দোলনেই বোঝা যায়।

 



Source: Book-TCSAILRS 1903/Thesis- K.C. Das 1989

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.