ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ৬ বছর পরেও মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের মূর্তি নির্মাণ হলনা কুচবিহারে।

লিখেছেন: কুমার মৃদুল নারায়ণ

শিববংশীয় মহারাজা বিশ্ব সিংহ (Maharaja Biswa Singha) দিয়ে কুচবিহারে যে রাজত্বের শুরু হয়েছিল, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২সেপ্টেম্বর ভারতভুক্তির মাধ্যমে ২২তম মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের (Maharaja Jagaddipendra Narayan/ Born: 15 December 1915, Death: 11 April 1970) রাজত্বের সময়ে এর অবসান ঘটে। একটি বংশের ৪৫০ বৎসরের উপর একটানা রাজত্ব পৃথিবীর বা ভারতের  ইতিহাসে  নেই বললেই চলে, যা কুচবিহার রাজবংশে সম্ভব হয়েছে। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ডিসেম্বর বর্তমান কুচবিহার রাজপ্রাসাদে মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ও মহারানি ইন্দিরা দেবীর প্রথম পুত্র জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ গৃহশিক্ষক অশ্রুমান দাশগুপ্তের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। গৃহে অল্পদিন শিক্ষার পর মহারাজা প্রথম ইংল্যান্ডের ইস্টবোর্ণের সেন্ট  সেঞ্চুরিয়ান স্কুলে, এরপর হ‍্যারোতে(Harrow School) (১৯২৭-২৯) এবং পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে (Trinity College, Cambridge) (১৯২৯-৩৪) উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি দেরাদুনের প্রিন্স অব ওয়েলস রয়াল মিলিটারি একাডেমিতে অধ্যায়ন শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেভেন লাইট ক্যাভালরিতে যোগদান করেন। মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণের অকাল প্রয়াণে মাত্র ৭ বছর বয়সে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নাবালক মহারাজ সিংহাসন আরোহন করায়, রিজেন্সি কাউন্সিলের দ্বারা শাসন পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। রাজমাতা ইন্দিরা দেবী এই কাউন্সিলের সভানেত্রী হিসেবে কাজ কর্ম পরিচালনা করতেন। ১৯২৩ সালের ২১ মে রিজেন্সি কাউন্সিল গঠিত হয়। এরপূর্বে পর্যন্ত স্টেট কাউন্সিল সবকিছু তদারকি করতো। ১৯৩৬সালের ৬এপ্রিল মহারাজের ২২ বৎসর পূর্ণ হলে সেই সময় গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন কর্তৃক এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা পরিচালনার ক্ষমতা পান। মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ (Maharaja Jagaddipendra Narayan) স্বহস্তে রাজ্য শাসন গ্রহণ করার পর প্রায় প্রত্যহ কুচবিহার শহর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে সকালবেলায় ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে ঘুরে শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পরিদর্শন করতেন। তার সঙ্গে ছোটভাই ইন্দ্রজিৎ ,ছোট বোন গায়েত্রী দেবী ও খুড়তুতো ভাই গৌতম নারায়ন থাকতেন । রাজপরিবারের পুরনো ধারাকে বজায় রেখে মহারাজা বহুবার শিকারযাত্রায়  অংশগ্রহণ করেছেন। তার রাজত্বকালে রাজ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য শিল্প ,খেলাধুলার উন্নতি সঙ্গে সঙ্গে শাসন প্রণালীর বিশেষ উন্নতি হয়।

শিক্ষানুরাগী মহারাজা সময় পেলেই বিভিন্ন স্কুলের  শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। বিভিন্ন সময়ে মহাকুমা পরিদর্শনে যেতেন, তেমনি রাজধানী শহরের অফিসগুলিও মাঝে মাঝে পরিদর্শন করতেন এবং কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতেন ।

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৯-৪০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা ‘এ’ গ্রুপ পাইলট হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে লাইসেন্স প্রাপ্ত হন এবং তিনি ভারতের বিভিন্ন ফ্লাইং ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ভারতের সেনাবিভাগে তিনি সম্মানীয় পদে নিযুক্ত ছিলেন। মহারাজ এর নিজস্ব প্লেন  ছিল এবং তিনি নিজে প্লেন চালিয়ে একাধিকবার কুচবিহারে এসেছেন ।

মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ধীর, স্থির, গুণীজনের গুনগ্রাহী, প্রজাদরদী ও সুবিচারক ছিলেন। তিনি কুচবিহারে থাকলে প্রতি শুক্রবার সকাল এগারোটা থেকে প্রজাদের অভাব-অভিযোগ, আবেদন-নিবেদন শুনতেন এবং প্রয়োজন মতো অতি শীঘ্র তার প্রতিকার করতেন।

মহারাজা খেলাধুলা খুব ভালোবাসতেন এবং নিজেও খেলতেন। ক্রিকেট ফুটবল ব্যাডমিন্টন খেলায় পারদর্শী ছিলেন। ১৯৪৩-৪৪ সালের রঞ্জি ক্রিকেট ফাইনালে তিনি ছিলেন বাংলা দলের অধিনায়ক। ক্রিকেট  খেলায় কুচবিহার কাপ (Coochbehar Cup) জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলি এখনো তার স্মৃতি বহন করেছে। তার পৃষ্ঠপোষকতায ১৯৫০ সালে কুচবিহার জেলা ক্রীড়া সংস্থা গড়ে ওঠে। পোলো খেলার মাঠ কে তিনি বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করেন। এই মাঠ পরবর্তীতে যুদ্ধের বিমান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে মহারাজা বিভিন্ন সময়ে রাজবাড়ীর মাঠে ক্রিকেট খেলার আয়োজন করতে থাকেন। সেই সময়ে দেশ-বিদেশের অনেক নামী দামী খেলোয়াড় এখানে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৬৮ সালে রাজবাড়ির মাঠে শেষ খেলা হয়। এই খেলায় নবাব পাতৌদি (Mansur Ali Khan Pataudi) অংশগ্রহণ করেন।

স্বর্গীয় পিতা মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণের  স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করার কেন্দ্র হিসেবে জিতেন্দ্র নারায়ণ ক্লাবের সূচনা করেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি। ক্লাবটি বর্তমানেও বহুমুখী কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে আছে। প্রজাবৎসল মহারাজা জিতেন্দ্র  নারায়ণ হাসপাতালের (MJN Hospital) বহিঃ বিভাগ চালু করেন ১৯৪৬ সালের ৪ইডিসেম্বর। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুলাই শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশে পশুদের জলখাওয়ার জন্য পাকা জলাধার নির্মাণ করেন ।

১৯৩৮-৩৯ আর্থিক বছরের দুধের চাহিদা পূরণের জন্য কুচবিহার শহরে হরিয়ানা থেকে গাভী এনে ডেয়ারি ফার্ম তৈরি করেন ।

পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২এপ্রিল কুচবিহার স্টেট মোটরস পরিসেবার সূচনা করেন। বর্তমানে যা নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট নামে পরিচিত ।এর প্রথম যাত্রাপথ ছিল ফালাকাটা থেকে কুচবিহার ।

কুচবিহার শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বর্তমানে যা রামকৃষ্ণ মঠ নামে পরিচিত মহারাজা দানপত্রের মাধ্যমে ২২/৭/১৯৪৯ তারিখে জমি দান করেন।

কুচবিহার শহরের উত্তরে খাগড়াবাড়ি অঞ্চলে ১৯৪৭ সালে মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণ তারই নামাঙ্কিত হাসপাতালে (জে.ডি হাসপাতাল) একটি টিউবারকিউলোসিস ক্লিনিকের আউটডোর তৈরি করেন। পরবর্তীতে দেওয়াসের(Dewas) হিজ হাইনেস মহারাজ যশবন্ত রাও পাওয়ার এই ক্লিনিকের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ এই ঐতিহ্যবাহী হাসপাতাল তার কৌলিন্য হারিয়ে ফেলেছে। ভারত স্বাধীনতার দু’বছর পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে তিনি কুচবিহার রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সময় কয়েক মাসের জন্য কুচবিহার রাজ্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হয়। পরবর্তীতে এক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রে কুচবিহার রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রান্তিক  জেলায় পরিণত হয় ১৯৫০সালের ১লা জানুয়ারি। রাজ্য হারা, নিঃসন্তান মহারাজা এরপর কুড়ি বছর জীবিত ছিলেন। রাজ্য হারলেও আমৃত্যু তিনি দেশের আইন অনুযায়ী “মহারাজা” (Maharaja) হিসেবে স্বীকৃতি এবং ভারত সরকারের দ্বারা নির্ধারিত রাজন্য ভাতা পেয়েছেন।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা জর্জিনা ইগান, (Gina Narayan) কুচবিহারে ইনি জিনা দেবী  নামে পরিচিতা, নামে এক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে কোন সন্তানাদি ছিল না।

১৯৭০ সনে ১১ই এপ্রিল কলকাতায় কুচবিহারের  মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণ মাত্র ৪৮ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে পৃথিবীতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক রাজবংশের অবসান হলো। মহারাজের কোন সন্তানাদি না থাকায় অনুজ ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণের পুত্র বিরাজেন্দ্র নারায়ণ মুখাগ্নি ও শ্রদ্ধাদি ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করেন।

ভারত ভুক্তির সময় জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের প্রজাগনের উদ্দেশ্যে বিদায় শুভেচ্ছা –

কুচবিহার রাজ্য ভারত ডোমিনিয়ন (Indian Dominion) অন্তর্ভুক্তি হওয়ার সময় কুচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ তার প্রজাবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে যে বিদায় শুভেচ্ছা ঘোষণা করেছিলেন তা নিম্নরূপ –

On this solemn occasion which marks the end of long and Happy association, my mother and I send you our best wishes, my beloved people.

Wherever we may be, we shall never forget you, your loyalty and your devotion, we hope you will always maintain the peace, Goodwill, and harmony which has been common heritage.

We shall always watch with keen interest your moral and material welfare and always pray for your happiness and prosperity.

May god almighty bless you all.

Jagaddipendra Narayan

কুচবিহার রাজ্য থেকে জেলা

কুচবিহার রাজ্যে থেকে জেলায় পালাবদলের  রাজনৈতিক কিংবা শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের  একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় তার নাম  উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। প্রজা কল্যাণের স্বার্থে তিনি অনেক কিছুই ত্যাগ করে গেছেন। যাইহোক পূর্ব ভারতের হিন্দু রাজ্যে পরিচয় বহনকারী মহারাজা বিশ্বসিংয়ের সুযোগ্য উত্তরসূরি মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভারত স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরবর্তীতে সমস্ত রাজনৈতিক ডামাডোল, পাকিস্তানপন্থী ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে কুচবিহার রাজ্যকে ভারত ইউনিয়নে শামিল করে প্রজাগনদের বাঁচিয়ে গেছেন। এটাই মহারাজার তার রাজত্বকালের অন্যতম একটা বড় কৃতিত্ব। না হলে এখানকার পরিণাম কি যে হতো আমরা এখন বাড়িতে বসেই অনুমান করতে পারি।

কুচবিহারের ইতিহাসে শেষ মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের  যতটা প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল, তা তিনি পাননি। বিশেষ করে জেলায় পরিণত হওয়ার পর। ভারতভুক্তির সময়ে মহারাজা কোটি টাকার অধিক রেখে গিয়েছিলেন কুচবিহারের অধিবাসীদের উন্নতিকল্পে, কথাটা হলো মহারাজা তো টাকাটা নিজেই খরচ করতে পারতেন। তিনি করেননি। প্রজা কল্যাণের স্বার্থে এরকম অনেক নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন। বরং সরকার এবং বেশিরভাগ কুচবিহারের  অধিবাসীগণ মহারাজাকে ভুলে গেছেন।

২০১৪ সনে অনেক ঘটা করে মহারাজার জন্মশতবর্ষে কুচবিহার স্টেডিয়ামে মহারাজার মূর্তি স্থাপনের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। সঠিক উন্মোচন করেছিলেন তৎকালীন বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন। ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়নি। বর্তমানে সেই ভিত্তিপ্রস্তরটি আগাছায় ছেয়েছে। এটাই কি ছিল মহারাজার প্রাপ্য? মহারাজার  হয়তো ভোটব্যাঙ্ক নেই।


তথ্যসূত্র: হিমাদ্রি শংকর ভট্টাচার্য্য কুচবিহারের রাজবংশীবলী ও বর্তমান রাজপ্রাসাদ, উত্তর প্রসঙ্গ, রাজ্য কুচবিহারের রাজকাহিনী ও বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত।

6 thoughts on “ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ৬ বছর পরেও মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের মূর্তি নির্মাণ হলনা কুচবিহারে।”

  1. সত্যি কত আর বঞ্চনা সইতে ও দেখতে হবে। সরকারে শুভ বুদ্ধির সূচনা হউক। অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ উপস্থাপনা এক কথায় অনবদ্য ।

    1. সত্যি কত আর বঞ্চনা সইতে ও দেখতে হবে। সরকারে শুভ বুদ্ধির সূচনা হউক। অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ উপস্থাপনা এক কথায় অনবদ্য ।

      1. কলকাতা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গের যেকোনো সরকারই এই ট্রিটমেন্টই দেবে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সর্বদা একই থাকবে।

Leave a Reply to M. C. Roy Cancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *