
স্বাধীন কুচবিহার রাজ্যের প্রায় পাঁচশত বছরের শাসনকালে অনেক বৈদেশিক শক্তি, পার্শ্ববর্তী দেশের আক্রমণ এবং বিভিন্ন শাসকদের দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছিল।এমনকি কুচবিহারের মহারাজাকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ইতিহাস সাক্ষী। দীর্ঘকাল বহিঃশত্রুর আক্রমণ এর ফলে রাজ্য হরন হয়েছিল এবং পুনরুদ্ধার ও হয়েছিল। বছরের পর বছর বহিঃশত্রুর আক্রমণের ফলে অনেক সময় কুচবিহারের মহারাজারা বিপক্ষ শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে বা রণকৌশলে সমকক্ষ হয়ে উঠতে না পেরে অনেকের সাহায্যেও নিয়েছিল, ইতিহাস তাই বলে। এই বহিঃশত্রুদের মধ্যে অন্যতম ছিল ভোটান / ভুটান। কুচবিহার রাজ্যের সঙ্গে ভুটান সরকারের বিরোধ শুরু হয় বিভিন্ন কারনে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ডুয়ার্সের সীমানা। শুধু তাই নয়, কুচবিহার রাজসিংহাসনে কে বসবেন সেই বিষয়েও ভুটানের রাজার নাক গলানো বা তার মতামত বা নির্দেশকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো বিষয়ও বিরোধের অন্যতম কারণ।কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছিলেন।এছাড়াও ভুটিয়ারা বছরের পর বছর কুচবিহারের প্রজাদের উপর দৌরাত্ম্য, লুণ্ঠন, অত্যাচার, নারায়ণী মুদ্রার আদলে নকল মুদ্রার প্রচলন, নিরীহ ব্যক্তিদের অপহরণ করে ক্রীতদাস বানানো কোন কিছুই তারা বাদ রাখেনি বরং দিনের পর দিন এই দৌরাত্ম্য তাদের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তাদের স্পর্ধা

চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যখন ভুটিয়ারা ভোজসভার নাম করে ১৭৬৯ সালে কুচবিহারের মহারাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়নকে (Maharaja Dhairjendra Narayan) অপহরণ করে তাদের রাজধানী পুনাখায় নিয়ে যায় এবং কুচবিহার রাজ্যে দখল করে নেয়। ইংরেজ মধ্যস্থতায় মহারাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ মুক্তি পান ১৭৭৪ সালে। তিশু লামার মধ্যস্থতায় ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে এপ্রিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ভুটান সরকারের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ডুয়ার্স এলাকার কিছু ভূখণ্ড কেরান্তি, মড়াঘাট, পাগলাহাট, লখিপুর প্রকৃত ব্যবসায়ী শাসক ব্রিটিশরা ভুটিয়াদের দিয়ে দেন। ব্রিটিশদের সাহায্যে মহারাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণের উদ্ধারের পর থেকেই কুচবিহার রাজ্য ব্রিটিশদের করদ মিত্র রাজ্যে পরিণত হয়।
সাময়িক যুদ্ধবিরতি, শান্তি, স্থিতিবস্তা বজায় থাকলেও ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল ভুটিয়াদের নজর।তারা আরো বেশি বেশি অঞ্চল বা এলাকা দাবি করতে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভুটানকে সন্তুষ্ট রাখতে কচুয়ামারি, রায়চিঙ্গা, তপসীখাতা, মাঝেরডাবরি, পারোরপার ,পালুগাঁও, ভলকা, চোকেয়াখেতি, সন্তরাবারী, চামুর্চি এবং আরো বিস্তীর্ণ এলাকা ভুটিয়াদের প্রদান করেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করার জন্য ও ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য ব্রিটিশরা ভুটানকে তোলা দিয়ে চলে ছিলেন এই সময়। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে জানুয়ারি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যায়, ভুটানকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য ব্রিটিশরা অনেক সময় ভুটান সরকারের অনায্য দাবি বা তাদের চুক্তির শর্ত ভঙ্গকেও মেনে নিয়েছিল।
ব্রিটিশ সরকার ভুটান সরকারের অনার্য দাবি, অত্যাচার এমনকি তাদের করদ মিত্র রাজ্যে কুচবিহার, সিকিম, প্রজাদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার প্রথমদিকে হালকা ভাবে না নিলেও ক্রমান্বয়ে অত্যাচার, লুণ্ঠন, দৌরাত্ম্য বেড়ে চলায় ব্রিটিশ সরকার ভুটান সরকারকে অনুরোধ করে তারা যেন এই সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে। ভুটান সরকার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আবেদনে কর্ণপাত করে না। তারা তাদের আগ্রাসন চালিয়ে যায়। এমত অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার (British India Government) আর কোন উপায় না পেয়ে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে দূত হিসেবে ভুটান রাজদরবারে তাদের প্রতিনিধি “অ্যাশলে ইডেনকে” (Ashley Eden, British representative) বিরোধ মেটানোর জন্য পাঠান। ভুটান সরকারের প্রকৃত রূপ ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রকাশ পায় যখন তাদের প্রতিনিধিকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ, লাঞ্ছনা ও জোর করে চুক্তিপত্রে সই করে নেওয়া হয়। যদিও অ্যাশলে ইডেন কোনক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে ফেরেন। ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে অপমান করার অর্থ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়াকে অপমান। অতঃপর ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ভুটান সরকারকে তাদের অনৈতিক কার্যকলাপ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরিভাবে দমন করার।

দুয়ার যুদ্ধ ও সিন্চুলা চুক্তি / Dooar War and Sinchula Treaty
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ সরকার ও সহযোগী কুচবিহার রাজ্যে ভুটানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ “দুয়ার যুদ্ধ” (Dooar War) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে ভুটানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের ফলে তাদের আগ্রাসন চিরকালে এই অঞ্চলে বন্ধ হয়ে যায়। কুচবিহার এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যৌথভাবে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগ্রামে ভুটানের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়। তারা ভুটানের অভেদ্য দূর্গ দেওয়ানগিরি (Dewangiri Fort or Deothang Fort) , ডালিমকোট (Dalim Fort) ধ্বংস করে দেয়। যদিও ভুটানের নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। এই যুদ্ধে কুচবিহার রাজ্যের কর্নেল হেদায়েত আলী (Cornel Hedayet Ali) বীরত্বের পরিচয় দেন। পাঁচ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে ভুটানিরা পরাজয় স্বীকার করলে সিঞ্চুলা চুক্তির (১১ই নভেম্বর ১৮৬৫ / Sinchula Treaty, 11th November 1865) মাধ্যমে যুদ্ধের এর অবসান ঘটে। বলা যেতে পারে এতদ অঞ্চলে ভুটান সরকারের আগ্রাসন চিরকালই বন্ধ হয়ে যায়।চুক্তির শর্ত অনুসারে–

কুচবিহার এবং ডুয়ার্সের আধিপত্যের দাবি প্রত্যাহার করে ন্যায় ভুটান সরকার। আসাম ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে দেয় ভুটান সরকার। বিনিময়ে তারা বাৎসরিক ৫০হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবে। পুনাখায় স্বাক্ষরিত ওই চুক্তি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলবৎ থাকে।ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসেবে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন গভর্নর-জেনারেল জন লরেন্স এবং ভুটান রাজা ইউগেন ওয়াংচুক। এই চুক্তির ফলে এই অঞ্চলে স্থিতাবস্থা ফিরে আসে।
Related Posts
কামতা সাহিত্যের এক ঝলক
বাংলা ও কামতাপুরী ভাষা প্রসঙ্গে মানীগুনী ব্যক্তিদের কিছু বক্তব্য – “কামতাপুরী ভাষা প্রসঙ্গ” ডঃ ধর্মনারায়ণ বর্মা ।
Tricks to purchase Hawaii cheap flights for 2023 travel