কলকাতা পরিচালিত বাঙালী রাজনীতি বনাম কামতা কুচবিহার নেতৃত্ব। Kamata Coochbehar Leadership.

VSarkar

 
কলকাতা পরিচালিত বাঙালী

কলকাতা পরিচালিত বাঙালী রাজনীতি আর কামতা কুচবিহারের আলাদা রাজ্যের আন্দোলন / Kolkata oriented Bengali Politics vs Kamata Coochbehar Leadership

Vivekananda Sarkar
Writer: Vivekananda Sarkar

যদি ব্রিটিশদের শাসনের কথা বলি তাহলে ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল 1947 সালের 15ই আগষ্ট আর সেই অর্থে কুচবিহার তার আগের থেকেই ব্রিটিশের করদযুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। রাজতন্ত্র বিরাজমান ছিল কুচবিহারে। রাজার হাতেই ছিল কুচবিহারের শাসনভার।

রাজা যখন কুচবিহারকে ভারতীয় ডমিনিয়নে (Indian Dominion) যুক্ত করল এবং কুচবিহারকে স্বতন্ত্র রাজ্যের মর্যাদায় অঙ্গীকারবদ্ধ হল তখনও সেই অর্থে সমস্যা হয়নি, কমিশনার নিযুক্ত করে দিল্লি থেকে শাসন করা শুরু হল সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নির্দেশে। সমস্যা শুরু হল তখনই যখন অন্যায়ভাবে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে চক্রান্ত করে কুচবিহার কে পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত করে সাদামাটা জেলায় পরিনত করা হল।

শুধু জেলায় পরিনত করা নয় তার সাথে সাথে দেশীয় সমস্ত নেতা নেত্রীবৃন্দ ছিল যারাই কুচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত করার বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা মামলা করে নিজেদের অর্থাৎ কংগ্রেসের পালে এনেছিল। শুধু নেতা গোছের মানুষদের তো নিজেদের পালে আনলে হবেনা সাধারন ও সচেতন মধ্যবিত্তদেরও তো আনতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু এনে এখানকার জনবিন্যাস পরিবর্তন করার চেষ্টায় থাকলেন। যদিও একথা অস্বীকার করা যায়না যে তখনকার ভারত বাংলাদেশ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনটাই ছিল মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। জনবিন্যাস যতই পরিবর্তন হবে তত কলকাতা পরিচালিত বঙ্গ রাজনৈতিক নেতাদের লাভ। যারা ওপার থেকে কাঁটাতার পেরিয়ে আসবে তাদের তো ব্ল্যাকমেইল করলেই আপনে আপ ভোট দেবে। ওরা বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে কলকাতা রাজনীতিতে নিজেদের নাম ঢুকিয়ে নিল আর রাজনৈতিক বিভিন্ন পদে আসীন হল আর স্থানীয় মানুষেরা চিরজীবন নিজেদের প্রাপ্য অধিকারের জন্য লড়াই করে গেল মাটির ঐকান্তিক উন্নতির স্বার্থে যা এখনো বিরাজমান। তবে আশাকরি কলকাতা পরিচালিত রাজনৈতিক নেতারা আর বেশিদিন এখানকার আপামর জনমানব কে টুপি পড়িয়ে রাখতে পারবে না। কারন ওপার থেকে আসা পরবর্তী প্রজন্ম আর এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের পরবর্তী প্রজন্ম সবাই অবহেলিত কলকাতা রাজনীতির চতুরতায়। এখন কাকে ব্ল্যাকমেইল করবে?

এরপরে কলকাতার নেতারা ভাবল কি ভাবে কুচবিহারের স্থানীয় মানুষদের অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দেওয়া যায় তাহলে এরা আলাদা রাজ্যের কথা ভুলে গিয়ে শুধু অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের চিন্তায় মজে থাকবে। স্থানীয়দের মধ্যে যারা তুলনামূলক ভাবে অবস্থাপন্ন ছিল তাদের আয়ের মূল উৎস ছিল জমি আর চাষ আবাদ। সুতরাং land ceilling করে দেওয়া হল আর সেই জমি উদ্বাস্তুদের আর স্থানীয় যারা গরীব ছিল তাদের মধ্যে দেওয়া হল। আর কিছু জমির কাগজের হেরফের করে বাঙালী প্রশাসনিক কর্তারা নিজেদের করে নিল। মরল শুধু স্থানীয়রা আর রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হল কলকাতা। কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী ছিল যারা পাটের বা বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্যের ব্যবসা করত  তাদেরকেও পুলিশ প্রশাসন দিয়ে হেনস্থা করে small business man থেকে ভিখারী বানিয়ে দিয়েছিল বিধান রায়ের কলকাতা প্রশাসন ও পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। 

 রাজনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি চলল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। এই অনচলের স্থানীয় ভাষা কামতাপুরী /রাজবংশী । যখন এখানকার মানুষ বুঝতে পারল যে স্কুলে কলেজে বাংলা ভাষা দিয়ে পড়াশুনার মাধ্যমে নিজেদের মাতৃভাষা তার সাথে কৃষ্টি সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে তখন মাতৃভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দেবার দাবিতে সরব হল। সেক্ষেত্রেও বঙ্গরাজনীতিবিদরা জোর জবরদস্তি বাংলাভাষাতেই পড়াশুনা করার কায়দা কৌশল করতে লাগল। আন্দোলনকারীদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। 

১৯৬০ সাল নাগাদ উত্তরখন্ড আন্দোলন থেকে শুরু করে কামতাপুরী আন্দোলন, গ্রেটার কুচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন সংগঠন তৈরী হল ভাষার মর্যাদা ও আলাদা রাজ্যের দাবীতে। 

এবার যদি ১৯৪৭ থেকে ঘটনা পরম্পরা অন্যভাবে বিশ্লেষন করার চেষ্টা করি তাহলে দেখা যাবে স্থানীয় কোচ রাজবংশী কামতাপুরী দের অনেকেই যারা কলকাতা পরিচালিত পার্টিতে অংশগ্রহণ করত তাদেরও অবস্থা করুন। উপেন্দ্র নাথ বর্মন কংগ্রেসের নাকি বড় মাপের রাজবংশী নেতা, ওনাকে এখানকার স্থানীয় মানুষদের কেউই চিনতনা, ফেসবুকের দৌলতে এখন কেউ কেউ চেনে। সিপিএম আমলেও এরকম কিছু রাজবংশী নেতা ছিল যারা শুধুমাত্র কলকাতার শাসকদের তল্পিবাহক ছিল। বর্তমানেও তাই। কলকাতা পরিচালিত কংগ্রেস, সিপিএম রাজনীতি করে যারাই এখানকার মাটির, এখানকার মানুষের উন্নতির কথা আলাদা ভাবে চিন্তা করেছিল হয় তারা খুন হয়েছিল নাহয় নিজের পার্টিতেই demotion হয়েছিল এবং পরবর্তীতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। উদাহরন হিসাবে বলি মোহিনীমোহন বর্মন, যজ্ঞেশ্বর রায় প্রমুখ যাদেরকে খুন করা হয়েছিল (see koch rajbanshi murder) কিন্তু কোনোরকম তদন্ত হয়নি বা বিচার পাওয়া যাইনি। ইদানীং কালে বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ বর্মনের (হেমতাবাদ) গলায় ফাঁস লাগানো দেহ, এতেও কারো শাস্তি হবেনা। 

দেশীয় নেতাদের মধ্যে এখন অনন্ত মহারাজ, বংশীবদন বর্মন, নিখিল রায় সহ আরো অনেকে আছেন। অতুল রায় বছর খানেক আগে মারা গেলেও তাঁর পার্টি কেপিপি (progressive) র কর্মকর্তারা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করছেন। 

দেশীয় নেতারা আলাদা আলাদা ভাবে রাজনীতি না করে যদি এককভাবে রাজনীতি করে রাজ্য সহ বিভিন্ন ইস্যুর জন্য আন্দোলন করে তবেই সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নচেৎ আপামর কোচ রাজবংশী কামতাপুরী এবং এখানকার বাংলাভাষাভাষী মানুষেরা ধরেই নেবে যে এরা সবাই নিজেদের উন্নতির জন্য মাঝে মধ্যে দলবল ভারী করে রাস্তায় নামছে আর ভোটের আগে সেটিং করে সমর্থন দেবে বড় বড় দলগুলিকে। এরা কখনো সিট শেয়ার নিয়ে আলোচনা করেনা শুধু ভোট শেয়ার নিয়ে সাপোর্ট করে – এই রাজনীতি বেশীদিন চলতে পারেনা।

অনন্ত মহারাজ (Ananta Maharaj) বিজেপির সাথে যুক্ত আছে বলে তৃণমূলের নেতারা অনন্ত মহারাজের পিছনে লেগেছে। অনন্ত মহারাজের প্রাসাদ নিয়ে আঙ্গুল তুলছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন কমল গুহ তিনি যেমন কোচ রাজবংশী সমাজ সংস্কৃতির বিরোধী তার পুত্র উদয়ন গুহ (Udayan Guha) ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে এসে সেই একই কায়দায় শান্ত কুচবিহারকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। যারা সাংবিধানিক নিয়মে আলাদা রাজ্যের জন্য আন্দোলন চালাচ্ছে কখনো তাদের হাটু ভেঙে দেওয়ার কথা বলছে আবার কখনো টিপ্পনি করছে যে তৃণমূলে মন্ত্রী হতে গেলে মাথাভাঙ্গা ও রায়, বর্মন, অধিকারী (কোচ রাজবংশীদের পদবী) হতে হবে। কমল গুহও একসময় এখানকার আদি বাসিন্দা কোচরাজবংশী কামতাপুরী দের বিরুদ্ধে অনেক বিষোদগার করেছিলেন। হেরিটেজ কুচবিহারের রাজপ্রাসাদ কে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর চক্রান্ত করেছিলেন, রাজ আমলের ঐতিহাসিক কুচবিহার লাইব্রেরীতে আগুন লাগানোর চক্রান্তকারী ছিলেন যার ফলে অনেক বহুমূল্যবান পুঁথি আমরা হারিয়েছি। রাজবংশী /কামতাপুরী ভাষায় রাজা মহারাজা আর সভাসদদের লেখা পুঁথি আমরা হারিয়েছি। 

অনন্ত মহারাজার (Ananta Maharaja) রাজপ্রাসাদকে প্রাসাদ না বলে গ্রামের খোলামেলা কারুকার্য করা ইটের বাড়ি বলাই ভালো। এর থেকে তৃণমূলের ছোটোখাটো বুথসভাপতি বা ব্লকসভাপতির শহরের বুকে অনেক বড় বড় বাড়ি আছে। অভিষেক ব্যানার্জির বাড়ি দেখলে তো পাগল হয়ে যাবেন। রাজ্য সরকার অনন্ত মহারাজের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছিল একসময় তাসত্বেও কিছু করতে পারিনি কারন যতদূর জানি এই প্রাসাদ নির্মানে ভক্তরা ১০০, ২০০, ১০০০ টাকা দান করেছিল। 

কলকাতা পরিচালিত সরকার সবসময় চাইবে কুচবিহার বা উত্তরবঙ্গের মাটিতে যেন কোনো জনপ্রতিনিধি তৈরী নাহয়। এমনকি নিজের পার্টিতেও কোনো নেতা যাতে এমন তৈরী নাহয় যার বিশাল অনুগামী হবে, নেতার কথাতে উঠবে আর বসবে। সবাই যেন কলকাতার নেতার কথাতেই চলে। 

অনন্ত মহারাজের ফ্যান ফলোয়ার দেখে অনেকেরই চক্ষু চরকগাছ, তার উপর কুচবিহার কে আলাদা রাজ্যের জন্য আন্দোলন আর দেশীয় রাজবংশী নেতা। তাই যেনতেন প্রকারে একে বধ করতেই হবে। 

অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে নির্বাচিত সরকার যখন কোনো ব্যক্তিবিশেষ ধর্মরাজ জনপ্রতিনিধি কে নিজেদের পালে আনতে পারেনা তখন নারী ঘটিত কোনো মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়, তার ইমেজের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেয়, মিডিয়াকেও আগের থেকে তৈরী করে রাখে যাতে নিমেষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়। অনন্ত মহারাজ এর ক্ষেত্রে এরকম আশঙ্কা করলেও অবাক হবনা। কোনো নারীকে আর তার পরিবার কে বিশাল টাকার লোভ দেখিয়ে সরকার তা করতেই পারে। তখন দেখবেন উত্তরের মিডিয়ার পাশাপাশি কলকাতার পরিবেষ্টিত মিডিয়াগুলোও উঠে পড়ে লেগেছে যে মিডিয়াগুলো এই অন্চলের কোনো খবরই রাখেনা।