বলরামপুর রাজবাড়ী, তুফানগঞ্জ। Balarampur Rajbari, Tufanganj, Coochbehar.

বাবা বলরামের নামাঙ্কিত স্থান “বলরামপুর” (Balarampur) কুচবিহার সাম্রাজ্যের বা রাজ্যের অতি পুরানো জনপদ। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বা অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে মহারাজা রূপনারায়ণের (১৬৯৩-১৭১৪) সময়ে কুচবিহার রাজবংশের প্রধান সেনাপতি (প্রতিরক্ষামন্ত্রী) ছত্রনাজির শান্ত নারায়ণ (Shanta Narayan) (জয়নাথ ঘোষের রাজোপাখ্যান এ উল্লেখিত) এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন।স্বাভাবিক কারণেই নাজির দেও বলরামপুরে বসবাস শুরু করলে তখন থেকেই বলরামপুর কুচবিহার রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নগরে পরিণত হয়। প্রাচীন এই নগরীর কুচবিহার ইতিহাসে বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। মহারাজা রূপনারায়ণের (Maharaja Rupnarayan) আমলে পারিবারিক বিবাদের কারনে নাজিররা চলে যান বলরামপুরে।

কুচবিহার রাজবংশের মহারাজাদের পরেই প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক ও দৈনন্দিন কাজে যারা অগ্রণী ভূমিকা নিতেন তারা ছিলেন “নাজির দেও”, “সুবা দেও” ও “দেওয়ান দেও”। মহারাজা লক্ষ্মীনারায়ণের সময় থেকে রাজবংশের সদস্যরা বা রাজজ্ঞাতিরা এই তিনটি পদ অলংকৃত করতেন। নতুন মহারাজার নির্বাচনে এবং অভিষেক ক্রিয়ায় পরামর্শদানে ছত্রনাজিরের মুখ্য ভূমিকায় থাকে। কাজেই তিনি ছিলেন রাজ্যের অন্যতম ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি। রাজ্যের সীমানা রক্ষা, বহিশত্রুদের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা, শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করা, রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং মহারাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব সবকিছুই রাজ্যের প্রধান সেনাপতি হিসাবে নাজিরকে দেখতে হতো। প্রভাবশালী ও পরাক্রমশালী নাজিরেরা এই কাজগুলি দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। নিঃসন্দেহে, অনেক “নাজির দেও” তাদের কৌশল, বুদ্ধি, দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী রাজবংশের গরিমা বৃদ্ধি করেছিলেন। “নাজির শান্তনারায়ণ” ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। খুব কম লোকই জানে তার বীরত্বের কথা। (শান্ত নারায়ান কর্তৃক দরিয়া বলাই মন্দির নির্মিত হয়েছিল, মুঘল আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন, রায়কতদের প্রভাব থেকে কুচবিহারকে মুক্ত করেছিলেন)। তিনি ছিলেন প্রথম নাজির দেও গোসাই মহিনারায়ণের পৌত্র এবং নাজির দেও দর্পনারায়ণের পুত্র।

নাজিরদেও বা মুখ্য সেনাধ্যক্ষ খগেন্দ্র নারায়ণের ক্ষমতার লোভ বা সিংহাসন লাভের আশায় রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং পরিশেষে নাবালক মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণ এবং রাজমাতা কান্তেশ্বরী দেবীকে বন্দি করার ফলে বলরামপুর এর সঙ্গে রাজবাড়ীর জ্ঞাতিবিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। আর এই সুযোগই খুঁজছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরই পরিণাম কুচবিহার রাজ্য পুরোপুরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বা নাজির দেউ খগেন্দ্র নারায়ণের সিংহাসন উচ্চভিলাসের জন্য অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে বলরামপুরের ঘটনা কুচবিহার রাজ্যের উপর ইংরেজ কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল।
খগেন্দ্র নারায়ণ (Khagendra Narayan) তার ইচ্ছে পূরণের জন্য রংপুরের কালেক্টর মিস্টার গুডল্যান্ড এর কিছুটা প্রচ্ছন্ন সাহায্য তিনি পান। খগেন্দ্র নারায়ণের বড়ভাই ভগবন্ত নারায়ন (খোড়া নাজির) রাজরক্ষী সুবেদার গোলাব সিং এর সাহায্য রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করেন। নাবালক মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণ, রাজমাতা কামতেশ্বরীদেবী, মহারাজার পিতামহী সত্যভামাদেবীকে বন্দী করে বলরামপুরে নিয়ে আসেন। মহারাজা, রাজমাতা ও আত্মীয়স্বজনকে উদ্ধার করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার নির্দেশে ইংরেজ ক্যাপ্টেন রটন সাহেব বলরামপুরে সেনা অভিযান চালিয়ে নাজিরদের পরাস্ত করে সকলকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন।রটন সাহেব নাজিরদের রাজপ্রাসাদে আগুন লাগিয়ে দেন এবং এতে ক্ষতি হয় রাজবাড়ীর।বন্দি করা হয় খোড়া নাজিরকে। ১৭৮৮খ্রিস্টাব্দের ২২শে জানুয়ারি ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস এই বিষয় নিয়ে তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন তৈরি করেন।কমিশনার মার্শী এবং শোভে তদন্ত করার জন্য কমিশনার নিযুক্ত হন।১৭৮৮খ্রিস্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর কমিশনারগণ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছে সুদীর্ঘ রিপোর্ট পেশ করেন। এই কমিশনের সুপারিশে নাজির খগেন্দ্রনারায়ণ রাজকার্য থেকে পদচ্যুত হলেন,তার সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং ৫০০টাকা মাসিক ভাতা ও বলরামপুরে তার বাসস্থানের চতুর্দিকে মাত্র এক ক্রোশ করে অঞ্চল দেওয়া হয় বাসস্থান এর জন্য। বর্তমানে ওই অঞ্চল ক্রোশি বলরামপুর নামে পরিচিত। রাজ সরকার কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দিলেন। সুতরাং এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ আধিপত্য যেমন প্রভাব বিস্তার করলো, ঠিক তেমনি নাজির দেও এর পদচ্যুতিতে এলাকার গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এলাকার গুরুত্ব কমে গেলেও নাজিরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি। পড়ে রয়েছে তাদের অবলুপ্ত ইতিহাস। ভগ্নপ্রায় ও ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে রাজবাড়ীর চ্যাপ্টা ইট ও পুরু দেওয়ালের কিছু অংশ। রয়েছে শিব দিঘি (Shiva Dighi) , বলাই দিঘি,ধোপা দিঘি। রয়েছে বিশাল পাথরের স্নানাগারের পাত্রটি, রয়েছে গোসানিমারি থেকে নিয়ে আসা তোরণের পিলারগুলি। স্মৃতিবিজড়িত এই বলরামপুরে নাজিরের বংশধরেরা বংশপরম্পরায় এখনও সেখানে বাস করেন।