প্রবন্ধ: উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহ – পরিতােষ কার্যী

উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহ

পরিতােষ কার্যী

সামাজিক বহু কুপ্রথার মতাে বাল্যবিবাহ একটি অতি ঘৃণ্য কুপ্রথা। যার প্রভাব সমাজবদ্ধ মানব জীবনে এক গভীর ক্ষয়ের সৃজন ঘটায় উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজজীবনে কেমন ছিল এই প্রথার রূপ বা আদৌ ছিল কিনা? তারই তত্ত্ব-তালাশ করার প্রচেষ্টাতে এই প্রবন্ধের অবতারণা।

রাজবংশী সমাজ ছিল মূলতঃ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। যেখানে মায়েদের অর্থাৎ নারীদের প্রাধান্যের কথা স্বীকার করা হয়। অবশ্য বহিঃকর্মের ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রাধান্য ঘটে। এই মাতৃতান্ত্রিক রাজবংশী সমাজের বাল্যবিবাহ প্রথা অতিমাত্রায় ছিলাে এটা কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। ভাবতে আশ্চর্য লাগে বর্ণহিন্দুরা যেদিন আপন কন্যা সম্তানকে কোলে করে বিয়ের পিড়িতে বসাতাে, বাল্যবিবাহের কুফল জেনে উঠতে পারেনি, কিংবা জানলেও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির রক্ত চক্ষুকে, তাঁদের অন্যায় নিয়মকে উপেক্ষা করতে পারেনি; সেই সময়কালে রাজবংশী সমাজ বিবাহের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিল। বিবাহে নারীদের প্রাধান্য ঘটে থাকে, তদুপরি রাজবংশী সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, তাই বিয়ের ব্যাপারে মায়ের কথাই শিরােধার্য রূপে গণ্য করা হত। তৎকালে রাজবংশী সমাজে বিবাহ উপযােগী বয়স কন্যার ক্ষেত্রে ছিল ১৬/১৭বছর, বরের ক্ষেত্রে ছিল ২১/২২ বছর। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, রাজোপাখ্যানে লিখিত আছে যে রাজা বিশ্বসিংহের পিতা হরিদাস মণ্ডলের (হরিয়া মণ্ডল) বিবাহ হয় রাজকন্যা হীরার সাথে। কন্যার মা প্রথমে এই বিবাহে রাজি হননি, কারণ হীরা তখন নয় বৎসরের বালিকা। ‘যৌবন প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত কন্যা পিতৃগৃহে অবস্থান করিবেন।’ হরিদাসের পিতা এই প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরেই কিন্তু হীরার সাথে বিবাহ ঘটা সম্ভব হয়েছিল, তার আগে নয়

এক্ষেত্রে বােঝা যাচ্ছে যে বর্ণ হিন্দুসমাজের প্রভাবের জন্য ইংরেজ সরকার ১৯৩০ সালে সারদা আইন লাগু করে বাল্য বিবাহকে নির্মূল করতে চাইল। স্থির হল বিবাহের ক্ষেত্রে বরের বয়স ২০-৩০ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৪-১৬ বছর হতে হবে। ডঃ চারুচন্দ্র সান্যাল জানিয়েছেন – “In Cooch Behar it was 10-12 for the girl and 20-23 for the boy”. কাগজে লিপিবদ্ধ আইন কাগজে থেকে গেল, তার সুবাস উত্তরবাংলার গণ্ডগ্রামে পৌছাতে পারলাে না। তাই আরাে বহুকাল বাল্য বিবাহ চলতে থাকল রাজবংশী সমাজে। ধীরে ধীরে এই জ্ঞানের আলাে এই বদ্ধসমাজের ফাক ফোকর দিয়ে প্রবেশ করার পর বহু কুসংস্কারের মতাে বাল্য বিবাহ ক্ষয় পেতে শুরু করে। অবশ্য তাতে স্বাধীন ভারত দয়া না করলে হয়তাে তাও হত না। কিন্তু আজো- কি হে রাজবংশী সমাজ বাল্যবিবাহের কালিমা সম্পূর্ণ মুছতে পেরেছে? কেন আজও কঙ্কালসার চতুদর্শী পঞ্চদশীরা সন্তান কোলে করে মৃত্যুর প্রতিক্ষা করে?

অতীতকালে রাজবংশী সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথা ছিল না। তাহলে এই সমাজে বাল্যবিবাহ কবে থেকে শুরু হয়? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে প্রথমে জেনে নিতে হবে বর্ণহিন্দুদের প্রভাব রাজবংশী সমাজে কবে থেকে পড়তে শুরু করে।

কোচ রাজবংশের প্রথম রাজা বিশ্বসিংহের পিতা হরিদাস মণ্ডল হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেননি। সমগ্র কোচ সমাজ আপন ধর্মচারণে নিয়ােজিত ছিল। তবে তখন সমগ্র কামরূপ রাজ্যে যে ব্রাহ্মণ ছিল না এমনটা নয়। কারণ রাজা নীলধ্বজের রাজত্বের সময়কালেও আমরা ব্রাহ্মণদের দেখা পেয়ে থাকি। হান্টার জানিয়েছেন – “হাজোর দৌহিত্র বিশুর সময়ে কোচ জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সর্ব প্রথমে প্রবিষ্ট হইয়াছিল এবং বিশু স্বকীয় কর্মচারী ও প্রধান অধিবাসীগণের সহিত হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।” ডাক্তার ক্যাম্বেল বিশ্বসিংহের ভ্রাতা শিষ্যসিংহ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন – যদিও রাজা (তৎকালীন রায়কত) আপনাকে হিন্দু বলিয়া প্রচার করিতে অভিলাষী, তথাপি তাঁহাকে প্রকৃত ‘হিন্দু বলা যাইতে পারে না।” অর্থাৎ একথা বলা যায় যে, রাজা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন সপরিষদ এবং প্রধান অধিবাসীদের নিয়ে একথা সত্য। কিন্তু হিন্দু ধর্মের সমস্ত নিয়ম কানুন, কৃষ্টি সংস্কৃতিকে পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারেননি। কারণ আপন মজ্জাগত সমাজ সংস্কৃতি এতাে সহজে মানুষকে মুক্তি দেয় না। হয়তাে এই কারণেই রাজা আপনাকে “হিন্দু” বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃত হিন্দু হতে পারেননি। আবার খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমেদ ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ গ্রন্থে জানিয়েছেন “বিশ্বসিংহের রাজ্য প্রাপ্তির সময় ইইতেই যে ইহাদের (কোচরাজবংশী) মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বনের সূত্রপাত হইয়াছে, এইরূপ উক্তির সমর্থক কোন প্রমাণ বিদ্যমান নাই। “আবার তিনি জানিয়েছেন – “সেখ আবুল ফজল ‘আকবর নামায়’ লিখেছিলেন যে বিশ্বসিংহের মাতা জল্পেশ্বর শিবের আরাধনা করিয়া তাঁহাকে পুত্র রপে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং বিশ্বসিংহের মাতা পিতা যে হিন্দু ছিলেন, তাহা নিশ্চিতভাবে জানিতে পারা যাইতেছে।” খান চৌধুরী আমানতউল্লাহের দেওয়া এই তথ্যকেও যদি আমরা সত্য বলে ধরি তবুও কিন্তু একথা বলা যায় একজন মণ্ডলের এক্তিয়ারে থাকা স্থানে তাঁর গৃহীত ধর্ম প্রজা সাধারণের ধর্মে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে এমনটা বলা যায় না বা ঘটেওনি। তবে প্রভাবিত করেছিল বা করাটা সম্ভব এটা ঠিক।

পরবর্তী রাজা বিশ্বসিংহের প্রথাগত পুরােহিত কলিতাদের এবং মৈথিলি ব্রাহ্মণদের তাদের পূজ্য আসন থেকে সরিয়ে দিয়ে শ্রীহট্ট থেকে বৈদিক ব্রাহ্মণদের আনেন। এই অনুগ্রহপুষ্ট ব্রাহ্মণরাই তার দৈব জন্মের কাহিনী প্রচার করেন। বুকানন লিখেছেন- “(বিশ্বসিংহের) দেবতার অংশে জন্ম গ্রহণের এই প্রচারিত কাহিনীকে অনুসরণ করে কোচেরা, অন্ততপক্ষে সেই সব কোচেরা, যারা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং তাদের অসংস্কৃত আচরণকে বর্জন করেছিল, তারা রাজবংশী অথবা রাজার বংশধর এই পরিচয় গ্রহণ করে। …..হীরার বংশধরগণ তাদের ঐশ্বরিকজন্মের খ্যাতিতে আরাে গর্বিত হয়ে দেব অথবা প্রভু পদবী গ্রহণ করে এবং রাজপরিবারের রাজদন্ডধারী সদস্যরা ব্যবহার করতে থাকে নারায়ণ পদবী। “সাম্প্রতিক এক আলােচনায় বলা হয়েছে যে, “বিশ্বসিংহ নিজে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন এবং শিব ও পার্বতীর উপাসক হন। ….সমস্ত কোচবিহারে তিনি হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এইসব মন্দিরে পূজার জন্য মিথিলা থেকে বাহ্মণ নিয়ে আসেন।” ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে কামরূপে কলিতা ও ব্রাহ্মণদের পৌরােহিত্যে যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তথা আর্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে হিন্দু ধর্ম অপেক্ষা বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবকেই ইঙ্গিত করে বেশি বলে মনে করেন অনেক পণ্ডিত। আসলে বিশ্বসিংহের আবির্ভাবের পুর্বে এক হাজার বছরের মধ্যে বঙ্গদেশের মতাে কামরূপ রাজ্যেও বৌদ্ধ মতের প্রভাব বিপুল। যে ধর্মীয় ব্যালান্স তিনি তৈরি করেছিলেন তাতে তাঁর ধর্ম প্রসার প্রচেষ্টায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। শেষপর্যন্ত রাজপোষকতা সত্ত্বেও ‘ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মাঝপথে থেমে গিয়েছিল।’ পরবর্তী রাজগণ মন্দির প্রতিষ্ঠা, দেবােত্তর সম্পত্তি দানছাড়া হিন্দু ধর্ম প্রচারে তেমন কোন রেখাপাত করে যেতে পারেননি।

পরবর্তীকালে উত্তরবঙ্গে ইংরেজ গবেষকদের আগমন রাজবংশীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি দিক থেকে প্রভাবিত করে। ইংরেজ আগমনের সাথে তাদের সৃষ্ট বাঙালি কেরানীকুল ঘাঁটি গাড়তে থাকে বিপুল পরিমাণে (তবে যে শুধু বাঙালি এসেছিল তা নয়)। পারস্পরিক সহাবস্থান পরস্পরকে প্রভাবিত করবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে রাজবংশী সমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব তথা প্রবেশ ঘটে রাজবংশী কুলমুকুট রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মার ক্ষত্রিয় আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে। আপাত অচ্ছুত ব্রাত্য ভঙ্গক্ষত্রিয় রাজবংশী সমাজকে গণউপবীত ধারণের মধ্য দিয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তরীতে ভিরিয়ে দিলেন। সেই সূত্রধরেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গুণগুলাের সাথে সাথে দোষগুলােও প্রবেশ করে রাজবংশী সমাজে। বাল্যবিবাহ ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি থেকেই পাওয়া।

Continue Reading..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *